একাদশ সংসদ নির্বাচনের বেশ সময় এখনো বাকি থাকলেও ওই নির্বাচন কোন প্রক্রিয়ায় হবে, নির্বাচনকালীন সরকারকাঠামো কেমন হবে, বর্তমান বাস্তবতার ধারাবাহিকতায় সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব কি না, তা নিয়ে পর্দার অন্তরালে নানা আলোচনা শুরু হয়েছে। অনানুষ্ঠানিক এসব আলোচনায় প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের শীর্ষনেতারা পরস্পরের মধ্যে যেমন নিজ নিজ দলের চিন্তাভাবনা বিনিময় করছেন, তেমনি কূটনৈতিক অঙ্গনও সোচ্চার হয়ে উঠেছে। সাম্প্রতিক সময়ে অন্তত তিনটি কূটনৈতিক অনুষ্ঠানে রাজনৈতিক নেতাদের উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়। জানা গেছে, এসব অনুষ্ঠানে রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে সৌজন্যমূলক আলোচনায় স্থান পেয়েছে বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন প্রসঙ্গ। আলোচনায় অংশ নিয়েছেন কূটনীতিকেরাও।
রাজনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, নির্বাচনমুখী চলমান রাজনীতিতে এখন প্রধান আলোচ্য বিষয় নির্বাচনকালীন সরকার এবং সুষ্ঠু একটি জাতীয় নির্বাচন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত বিতর্কিত নির্বাচনের পটভূমি তৈরি হওয়ায় আগামী নির্বাচন নিয়ে সোচ্চার আবারো অনেক পক্ষই। রাজনৈতিক দলগুলো ছাড়াও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ প্রভাবশালী দেশগুলো, একই সাথে প্রতিবেশী দেশ ভারতও চাচ্ছে আগামীতে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। জানা গেছে, ক্ষমতাসীন দলের নেতারা নির্বাচন নিয়ে প্রকাশ্যে দশম সংসদ নির্বাচনের মতো শক্ত অবস্থান ব্যক্ত করলেও ভেতরে তারা একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনেরই পক্ষে। সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনের অবাধ পরিবেশ তৈরির জন্য পরোক্ষ চাপও রয়েছে তাদের ওপর। সময় যত এগোবে, এ চাপ ততই প্রতিভাত হবে।
তবে দেশের রাজনীতিতে নির্বাচনী ইস্যু কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। এই ইস্যুতে কূটনৈতিক তৎপরতাও চলছে সমানতালে। জানা গেছে, গত এক মাসে ভারতীয় হাইকমিশনারের ইফতার মাহফিল, মার্কিন ডে উপলক্ষে আমেরিকান দূতাবাসের অনুষ্ঠান ও চীনা দূতাবাস আয়োজিত অনুষ্ঠানে রাজনৈতিক নেতারা বিশেষ করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতারা অংশ নিয়েছেন। এই তিন অনুষ্ঠানে ঘরোয়া আলোচনার বিষয় ছিল আগামী নির্বাচন। দুই দলের নেতারা কাছে বসে এ নিয়ে আলোচনা করেছেন। উভয় দলের উদারপন্থী নেতারা একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন। সেই নির্বাচন কোন প্রক্রিয়ায় হবে তা নিয়ে আলোচনায় বসার তাগিদও অনুভব করেছেন তারা।
অনানুষ্ঠানিক এসব আলোচনায় উপস্থিত বিএনপির এক নেতা নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগের শীর্ষ বহু নেতাই মনে করেন সব দলের অংশগ্রহণেই আগামী নির্বাচন হওয়া উচিত। এ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনা-সমঝোতার পক্ষেও তারা। তবে প্রকাশ্যে কিছুই বলতে পারছেন না। বিএনপির ওই নেতা মনে করেন, এখনো অনেক সময় আছে। শেষ পর্যন্ত একটি সমঝোতা হতেও পারে।
নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের দাবিতে সোচ্চার বিএনপি পরিকল্পিতভাবে সামনে এগোচ্ছে। জানা গেছে, নির্বাচনের পথে ইতিবাচক একটি অবস্থান নিয়েই দলটি নিজস্ব পরিকল্পনা সাজাচ্ছে। দলটির নেতারা বলছেন, নির্বাচন কমিশন গঠনপ্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রপতির সাথে সংলাপে অংশগ্রহণ এবং ক্ষমতায় গেলে নতুন ধারার রাজনীতি প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি সংবলিত ভিশন-২০৩০ আগামী নির্বাচন নিয়ে বিএনপির ইতিবাচক রাজনীতির উজ্জ্বল উদাহরণ। ভিশন-২০৩০ তুলে ধরার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে নেতারা বলেন, বিএনপি ক্ষমতায় গেলে কী করবে, তা কেবল রাজনীতি সচেতন জনগোষ্ঠী নয়, কূটনৈতিক অঙ্গন থেকেও বারবার জানতে চাওয়া হয়েছিল। বিএনপি সেই চিন্তা থেকেই ভিশন-২০৩০ তুলে ধরেছেÑ যা এখন দলের কর্মসূচিতে রূপ দেয়া হয়েছে। জানা গেছে, ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে আগামী কয়েক মাসের মধ্যে নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের রূপরেখা তুলে ধরবে বিএনপি। এরপর এই দাবিতে দলটি কর্মসূচির মাধ্যমে সোচ্চার হবে। দলটির নেতারা বলেছেন, বিএনপি এমন একটি রূপরেখা দেবে, যাতে বল সরকারের কোটেই থাকে। সেই বল তারা কিভাবে খেলবে, তাদের ওপরই তা নির্ভর করবে।
বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, এ বছরের শেষে বা আগামী বছরের শুরুতে নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে মাঠে নামতে বিএনপির হাইকমান্ডকে পরামর্শ দিচ্ছেন কেউ কেউ। তবে এ ক্ষেত্রে দলটি বেশ সতর্ক। রাজনৈতিক সমঝোতাকে প্রাধান্য দিয়ে সামনে এগোনোর কৌশল নিচ্ছেন তারা। পরিস্থিতি অনুকূলে থাকলে আগামী বছরের শুরুতে অথবা নির্বাচনের ছয় মাস আগে সর্বাত্মক আন্দোলনের পথ বেছে নেয়া হতে পারে।
আগামী মাস ছয়েকের মধ্যে দেশে আন্দোলনের একটি উপযুক্ত ক্ষেত্র তৈরি হতে পারে বলে মনে করছেন বিএনপির শীর্ষপর্যায়ের কোনো কোনো নীতিনির্ধারক। ওই সময় নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের দাবিতে জোর আন্দোলনের বিষয়টিও সক্রিয় ভাবনায় রয়েছে বলে জানা গেছে।
দলের নীতিনির্ধারকেরা বলছেন, সব কিছু নির্ভর করছে পরিস্থিতির ওপর। তবে এবার তারা কোনো ভুল করতে চান না। ২০১৫ সালের মতো পরিকল্পনাহীন কোনো আন্দোলনও আর হবে না।
পরিস্থিতি বিচার-বিশ্লেষণ করে উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি হলেই আন্দোলনে নামবে দলটি।
বিএনপির একাধিক শীর্ষনেতা বলেছেন, বিএনপির শুভাকাক্সক্ষী বন্ধুপক্ষগুলো এবারের আন্দোলনে পুরোপুরি সমর্থন দেবে। কূটনীতিক পর্যায়েও তারা আলোচনা করছেন। প্রতিবেশী দেশ ভারতও চায় এবার বাংলাদেশে সবার অংশগ্রহণে একটি নির্বাচন হোক।
