Home 20 আন্তর্জাতিক 20 ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতীয় যে কৃষকেরা বিদ্রোহ করেছিল

ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতীয় যে কৃষকেরা বিদ্রোহ করেছিল

ভারতীয় সেনা, যারা মূলত সিপাহী নামেই পরিচিত, ১৮৫৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে তারা যে বিদ্রোহ করেছিল তা মূলত ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ হিসেবেই পরিচিত।
ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে সাধারণ কৃষকেরাও অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল, যদিও বিদ্রোহে তাদের এই অবদান অনেকেই ভুলে গেছে -বলেন ইতিহাসবিদেরা।
একদল গবেষক তাদের সেই অবদান পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টায় কাজ করছেন এবং তা নিয়েই লিখেছেন সুনায়না কুমার।
উত্তর প্রদেশের মিরাট জেলায় বিজরৌল নামের একটি গ্রামে গত ১০ই মে ছোট একটি অনুষ্ঠান হয়। ১৮৫৭ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে সিপাহী বিদ্রোহের ১৬০ বছর পূর্তি উপলক্ষেই ওই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল।
ওই গ্রামের বাসিন্দারা তাদের পূর্বপুরুষ শাহ মালের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছে, সিপাহী বিদ্রোহে তাঁর অবদানের জন্য তাঁকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে গ্রামের মানুষেরা।
১৮৫৭ সালে প্রায় ৮৪টি গ্রামের হাজার হাজার কৃষককে মাঠ ছেড়ে হাতে অস্ত্র তুলে নিতে সাহস জুগিয়েছিলেন শাহ মাল।
কিন্তু ভারতের অনেক মানুষই এই সমৃদ্ধ ‘জমিদারের’ কথা শোনেনি।
“ওই জেলার মানুষদের ‘রাজা’ নাকি আমাদের বিজয় হচ্ছে তা নিয়ে এক ধরনের উত্তেজনার মধ্যে ছিলেন তারা”- ‘দ্যা খাকি রিজাল্লাহ’ নামক বইয়ে লিখেছেন রবার্ট হেনরি ওয়ালেস ডানলপ। ওই সময়ে তিনি সিভিল সার্ভিসের কর্মকর্তা ছিলেন। বিদ্রোহের সময়ে তিনি তার এলাকা ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন।শাহ মাল ছিলেন অসম্ভব রকমের সাহসী একজন মানুষ। তিনি অস্ত্র সংগ্রহ করতেন এবং দিল্লিতে বিদ্রোহীদের কাছে সেই অস্ত্র পাঠাতেন। বিদ্রোহের সময় তাঁর নেতৃত্বেই যমুনা নদীর ব্রিজ উড়িয়ে দিয়ে দিল্লিতে ব্রিটিশ হেডকোয়ার্টারের সঙ্গে মিরাটের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছিল।
১৮৫৭ সালের জুলাই মাসে শাহ মালের নেতৃত্বে অন্তত সাড়ে তিন হাজার কৃষক তলোয়ার ও বর্শা হাতে লড়াই শুরু করেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনাদের বিরুদ্ধে। যাদের কাছে ছিল অশ্বারোহী, পদাতিক বাহিনী ও আর্টিলারি রেজিমেন্ট।
ওই যুদ্ধেই প্রাণ হারান শাহ মাল।
শাহ মালের এই ঘটনা ব্রিটিশদের কাছে এক ‘ভুঁইফোঁড় ব্যক্তির’ ঘটনা যে কিনা হঠাৎ করে ‘এক গুরুত্বপূর্ণ বিদ্রোহী হয়ে উঠে’। এমনকি ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের ঘটনার সাধারণ বর্ণনায় – যেখানে বলা হয় সিপাহীদের ওই বিদ্রোহ উত্তর ভারতের সাবেক শাসকদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল- সেখানেও শাহ মালের প্রসঙ্গ তেমন গুরুত্ব পায়নি।
সিপাহী বিদ্রোহের গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশই ছিল ভারতের কৃষকেরা, অথচ তাদের অবদান ইতিহাসে তেমনভাবে তুলে ধরা হয়নি।
মিরাটের কজন ইতিহাসবিদ ও গবেষক এখন সেই বিদ্রোহী কৃষকদের ঘটনা তুলে ধরার চেষ্টা করছেন।
ভারতের সংস্কৃতি বিষয়ক ইতিহাসবিদ সুমন্ত ব্যাণার্জী তার বই ‘ইন দ্য ওয়েক অব নক্সালবাড়ি’তে লিখেছেন “১৮৫৭ সারের বিদ্রোহের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশই ছিল উত্তর ভারতজুড়ে হাজার হাজার কৃষকের বিদ্রোহ”।
“কিন্তু বুর্জোয়া ইতিহাসবিদদের কারণে সেসব কৃষকদের বিদ্রোহের কথা চাপা পড়ে গেছে” বলেন মি: ব্যাণার্জী।ব্রিটিশ রেকর্ড
বেশিরভাগ ঐতিহাসিক বিবরণে সিপাহী বিদ্রোহে অভিজাত চরিত্রের প্রসঙ্গ এসেছে।
কিন্তু সেই সময়ে ব্রিটিশদের রেকর্ড ঘাটলে সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণসহ জানা যাবে কী পরিমাণ কৃষক, কীভাবে সিপাহী বিদ্রোহে অংশ নিয়েছিল।
যেমন এখানকার তথ্যগুলোও ব্রিটিশদের ১৮৫৮ সালের রেকর্ড থেকে নেয়া হয়েছে, সেই সময়ে মিরাটের গ্রামে কীভাবে ব্রিটিশরা আক্রমণ করেছিল সেই ঘটনা থেকে জানা যায় কৃষকদের অভ্যুত্থানের কথা।
“বড় বড় গ্রামগুলো দখল করে ফেলা হয়েছিল। ভিন্ন ভিন্ন জায়গা থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী অনেক মানুষ নিহত হয়, ৪০ জনকে কারাবন্দী করা হয়, এদের সবাইকেই ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলানো হয়…”-বলছিলেন ইতিহাসবিদ ও লেখক অমিত পাঠাক।
শাহ মালসহ আরো যারা সাধারণ কৃষক সিপাহী বিদ্রোহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন, তাদের অবদান তুলে ধরার জন্য ব্রিটিশ রেকর্ডগুলো নিয়ে গবেষণা করছেন অমিত পাঠাক, ইতিহাসের অধ্যাপক কে.কে.শর্মা এবং গবেষক ও ইতিহাসবিদ রয় জেইন। এরা তিনজনই মিরাটের। এই তিনজনই বেসরকারি সংস্থা ‘কালচার এন্ড হিস্টরি সোসাইটি’র প্রতিষ্ঠাতা।
১০ বছর আগে ছিল সিপাহী বিদ্রোহের ১৫০তম বার্ষিকী। সেই সময়ে এই তিনজন ‘বাগি (বিদ্রোহী) গ্রামগুলো’ নামে একটি প্রজেক্ট শুরু করেন। ব্রিটিশ যেসব গ্রামের নাম ‘বাগি’ দিয়েছিলো সেগুলো মূলত স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছিল এবং ওই অঞ্চলগুলো আবারো ব্রিটিশরা দখলে নিয়ে নেবার পর গ্রামের বাসিন্দারা চরম প্রতিহিংসার মুখেও পড়েছিল।
ওই গ্রামগুলো চিহ্নিত করার পর গবেষকরা বিদ্রোহী যোদ্ধাদের উত্তরসূরিদের খুঁজে বের করেন এবং অনেক পরিবারের কথাও রেকর্ড করেন। পরিবারের সদস্যদের স্মৃতি, কিভাবে একের পর এক প্রজন্ম চলে গেল এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের সেসব বর্ণনাও উত্তরসূরিরা নথিভুক্ত করে রেখেছেন। সেগুলোও রেকর্ড করেছেন গবেষকেরা।
“সত্যিকারের বিদ্রোহ আসলে হয়েছিল ভারতের গ্রামাঞ্চলে” -বিবিসিকে বলেন মি: পাঠাক।”দু:খের বিষয় হলো ওই গ্রামগুলোতে বিদ্রোহীদের পরিবারের যেসব সদস্যরা এখন বাস করছেন তাদের বেশিরভাগিই খুব গরীব, আমরা দেখেছি কিভাবে দু:খ দুর্দশায় তাদের জীবন কাটছে”- বলেন অমিত পাঠাক।
দিল্লিতে যখন সিপাহী বিদ্রোহের অবসান ঘটলো তখন বিদ্রোহীদের ফাঁসিতে ঝুলানো হয় এবং তাদের জমিজমাও বাজেয়াপ্ত করা হয়। সেগুলো নিলামে তোলা হয় এবং যারা ব্রিটিশ সরকারের প্রতি অনুগত ছিল তাদের সেসব জমি প্রদান করা হয়।
“বুসোধ গ্রামে গিয়ে আমরা খুব অবাক হয়েছি, কিভাবে সমৃদ্ধশালী একটা গ্রাম ব্রিটিশদের অধীনে চলে গেল। আর কিভাবে সেটি জায়গাজমিহীন দরিদ্র শ্রমিকদের একটি গ্রাম হয়ে উঠলো। বেশিরভাগ গ্রামেরই এমন অবস্থা” -জানান গবেষক মি: পাঠাক।
গবেষকদের এ দলটি ১৮টি গ্রাম পরিদর্শন করেছে।
কিন্তু সরকারি কর্মকর্তারা কদাচিৎ এসব গ্রামে পরিদর্শনে যান।
গবেষকেরা বিদ্রোহীদের এমন পরিবারও খুঁজে পেয়েছেন যারা তাদের ইতিহাস সম্পর্কে কিছুই জানে না।মি: জেইন বলছেন শাহ মালের মতো বিদ্রোহীর গল্প সামাজিক সচেতনতার জন্য খুব জরুরী।
গুলাব সিং নামের আরেক বিদ্রোহীর পঞ্চম প্রজন্ম হলেন প্রমোদ কুমার ধামা। নিম্বালি গ্রামের কৃষকদের নেতা ছিলেন গুলাব সিং, যিনি শাহ মালের সঙ্গে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন।
৫০ বছর বয়সী মি: ধামা একটি স্কুলে পড়ান এবং গুলাব সিংয়ের অবদান নিয়ে তিনি খুব গর্ববোধ করেন।
“আমি যখন ছোট ছিলাম, তখন আমাকে বলা হয়েছিল এমন এক পরিবারে আমার জন্ম যেখানে একজন দেশের জন্য লড়াই করেছেন। ওই কথা আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছিল, আর সেই প্রেরণায় আমি এখন শিক্ষক”-বলেন মি: ধামা।
১৮ই জুলাই বিজরৌল গ্রামের বাসিন্দারা সিপাহী বিদ্রোহীদের নিহত কৃষকদের স্মরণে এক অনুষ্ঠান পালন করবে। ওই গ্রামেই শাহ মালসহ আরো ২৬ কৃষক নেতাকে একটি বটগাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে ফাঁসি দেয়া হয়। 

About Dhakar News

Leave a Reply

Your email address will not be published.

x

Check Also

খালেদা জিয়ার বিদেশ যেতে হলে জেলে গিয়ে আবেদন করতে হবে: আইন মন্ত্রণালয়

বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার আবেদন নাকচ করে মত দিয়েছে আইন মন্ত্রণালয়। রবিবার ...

ডিএমপির ৩৬তম কমিশনারের দায়িত্ব গ্রহণ

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ৩৬ তম কমিশনার হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করলেন অতিরিক্ত আইজিপি হাবিবুর রহমান বিপিএম-বার, ...

“কৃষ্ণসাগর নৌবহরের সদর দপ্তরে ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ৩৪ জন কর্মকর্তা নিহত”

সেভাস্তোপোলে রাশিয়ার কৃষ্ণসাগর নৌবহরের সদর দপ্তরের কমান্ডারকে হত্যার দাবি করেছে ইউক্রেন। দেশটির স্পেশাল অপারেশনস ফোর্সেস ...

আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রধানকে ‘ওয়ান্টেড’ ঘোষণা রাশিয়ার

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধে শিশু পাচারের অভিযোগ এনে যুদ্ধাপরাধের দায়ে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছিলেন ...

গাজীপুর সিটি করপোরেশন: মেয়রের প্রধান উপদেষ্টা হলেন জাহাঙ্গীর আলম

গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র জায়েদা খাতুনের প্রধান উপদেষ্টা হলেন ছেলে জাহাঙ্গীর আলম। যাকে এর আগে ...