ঢাকার কলাবাগানের রাস্তায় স্ত্রীকে পিটিয়ে সমালোচিত হওয়া কনস্টেবল রুহুল আমিন কারাগারে থাকলেও বসে নেই তাঁর স্বজনরা। তারা এ ঘটনায় থানায় দায়েরকৃত মামলা তুলে নিতে নির্যাতিত গৃহবধূর স্বজনদের হত্যার হুমকি দিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। আর নির্যাতনের ক্ষত নিয়ে এখনো ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বিছানায় কাঁতরাচ্ছেন নরসিংদীর গৃহবধূ নীলিমা সুলতানা শাহীনুর।এদিকে ঘটনার দুই সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও মামলার তদন্তে উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি নেই। অভিযুক্ত পুলিশ কনস্টেবলকে বাঁচাতে ঢিলেঢালা তদন্তের অভিযোগ নির্যাতিত পরিবারের।গত ১ জুলাই রাজধানীর সেন্ট্রাল হাসপাতালের বিপরীত পাশে রুহুল আমিন স্ত্রী নীলিমা সুলতানাকে মারধর করে ফুটপাত দিয়ে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন কয়েকজন পথচারী রুহুলকে থামায় এবং তাঁদের কলাবাগান থানায় সোপর্দ করে।নীলিমা সুলতানা শাহীনুর জেলার বেলাব উপজেলার টানলক্ষ্মীপুর গ্রামের মৃত শাফিউদ্দিনের মেয়ে। আর অভিযুক্ত স্বামী রুহুল আমিন একই উপজেলার বীর বাগবের গ্রামের ফজলু মিয়ার ছেলে। তিনি ট্যুরিস্ট পুলিশে কনস্টেবল হিসেবে কর্মরত।
পুলিশ ও নির্যাতিত নারীর পরিবারের লোকজন জানায়, ২০১২ সালে নীলিমা সুলতানা শাহীনুরের সঙ্গে কনস্টেবল রুহুল আমিনের বিয়ে হয়। বিয়ের পর থেকে তাঁরা বিভিন্ন বিষয়ে একে অন্যের বিরুদ্ধে ছয়টি মামলা করেন। এরই জের ধরে তাঁদের মধ্যে একবার ডিভোর্স হয়।
ডিভোর্সের পর মামলা থেকে বাঁচতে কনস্টেবল রুহুল আমিন আবারও শাহীনুরকে বিয়ে করলেও যৌতুকের জন্য শারীরিক নির্যাতন করে বাবার বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। গত ২৫ জুন শাহীনুর বেলাব বাজারে ঈদের কেনাকাটা করতে গেলে কৌশলে স্বামী রুহুল আমিন তাঁকে পুনরায় বাড়িতে নিয়ে যান। একপর্যায়ে ১০ লাখ টাকা যৌতুক দাবিতে রুহুল আমিন, শ্বশুর ফজলু মিয়া, মা হামিদা খাতুন ও চাচা শ্বশুর মুশফিক মিয়া শারীরিক নির্যাতন করেন। অনাহার ও শারীরিক নির্যাতনে গৃহবধূ শাহীনুরের হাত-পায়ে গুরুতর জখম হলে তাঁকে চিকিৎসা না করিয়ে শিকল পরিয়ে আটকে রাখা হয়। টানা এক সপ্তাহ এই অমানুষিক নির্যাতন চলা অবস্থায় শাহীনুরের পরিবারের লোকজন বেলাব থানার পুলিশকে নিয়ে কয়েকবার স্বামীর বাড়িতে যায়। কিন্তু রহস্যজনক কারণে পুলিশ নির্যাতনের শিকার গৃহবধূ শাহীনুরকে উদ্ধার করেনি। গত ১ জুলাই তাঁকে ডাক্তার দেখানোর কথা বলে ঢাকায় নিয়ে এসেছিলেন রুহুল আমিন। কিন্তু শাহীনুর তাঁকে মানসিক রোগী বানানোর ষড়যন্ত্রের বিষয়টি টের পেয়ে চিৎকার করলে আশপাশের লোকজন এগিয়ে আসে। ওই সময় রুহুল আমিন নীলিমার ওপর চড়াও হন। তাঁকে রাস্তায় ফেলে বেধড়ক মারধর করেন। নীলিমার চিৎকারে লোকজন তাঁদের আটক করে পুলিশে খবর দেয়। তবে ওই গৃহবধূর শরীরে আঘাতের অনেক চিহ্ন রয়েছে।
নীলিমাকে পেটানোর একটি ভিডিও ও কিছু স্থিরচিত্র ফেসবুকে দেন বেনজির আহমেদ রায়হান নামের এক ব্যক্তি। ভিডিও চিত্রটি ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে পড়লে দেশজুড়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। এ ঘটনায় নির্যাতিত শাহীনুর বাদী হয়ে কলাবাগান থানায় স্বামী রুহুল আমিনের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা দায়ের করেন। পুলিশ রুহুল আমিনকে ওই মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠিয়েছে। আর নির্যাতনে অসুস্থ শাহীনুরকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
নির্যাতনের শিকার শাহীনুরের বড় ভাই আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘রুহুল আমিন পুলিশের চাকরি করার সুবাদে ক্ষমতার অপব্যবহার করে দীর্ঘদিন ধরে আমার বোনকে অমানুষিক নির্যাতন করেছে। আমরা পুলিশের কাছে বারবার সহযোগিতা চেয়েও পাইনি। এখন সেই নির্যাতনের ক্ষত নিয়ে এখন সে হাসপাতালে মরণ যুদ্ধে লড়াই করছে।
শাহীনুরের বড় বোন হনুফা বেগম বলেন, ‘শাহীনূরের মামলায় অভিযুক্ত স্বামী রুহুল আমিন কারাগারে যাওয়ায় তার স্বজনরা প্রতিনিয়ত মামলা তুলে নেওয়ার জন্য আমাদের চাপ দিচ্ছে। অন্যথায় তারা আমাদের মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে বলছে, রুহুল আমিন পুলিশে চাকরি করে, পুলিশ তাদের কিছুই করবে না। তারই প্রতিফলন পুলিশের গাছাড়া তদন্ত। এ অবস্থায় আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে অসহায় শাহীনূরের নির্যাতনের দৃষ্টান্তমূলক বিচার এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসার দাবি জানাচ্ছি। ’
এদিকে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ঢাকার কলাবাগান থানার উপপরিদর্শক (এসআই) এনামুল হকের ভাষ্যেই ফুটে ওঠে তদন্তে গাছাড়া ভাবের অভিযোগ। যোগাযোগ করা হলে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ঘটনাস্থল কলাবাগানে মারধরের কোনো সতত্যা পাওয়া যায়নি। আর এজাহারে উল্লিখিত নির্যাতনের ঘটনাস্থল আমার এলাকায় নয়, বেলাব থানায়। বিষয়টির তদন্ত করবে বেলাব থানার পুলিশ। ’
মামলার অভিযোগের তদন্ত এলাকাভিত্তিক হয় নাকি এজাহারভিত্তিক হয়—জানতে চাইলে এনামুল সদুত্তর দিতে পারেননি। পরে বলেন, ‘মামলার তদন্ত মাত্র শুরু হয়েছে। এ ব্যাপারে বেলাব থানার পুলিশের সহযোগিতা চাওয়া হবে। কিন্তু নির্যাতিত শাহীনূর আমাকে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করছেন না। এমনকি তাঁদের হুমকির বিষয়টিও আমি অবগত নই। ’