বাঙালির আলাদা একটা রাষ্ট্র প্রয়োজন ছিল। নিরাপদ আবাসনের প্রয়োজন ছিল। প্রয়োজন ছিল নিজস্ব সংস্কৃতি, বৃষ্টি ও ঐতিহ্যের বাতাবরণে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার। এমন ভাবনা তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়া আর কারও কাছে পায়নি বাঙালি। বাঙালির আশা-আকাঙ্ক্ষা-সুখ-দুঃখ বুকে লালন করে বাঙালির পক্ষে কথা বলেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এ ভূখণ্ডের চাহিদার কথা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। দেশবাসীর আশা-আকাক্সক্ষাটি সঠিকভাবে ধরতে পেরেছিলেন। আর সে অনুযায়ী লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য কাজ করেছিলেন। সেজন্য জীবন বাজি রেখেছেন।
ছয় দফা দাবি বাস্তবায়নের জন্য তিনি কাজ করেছেন। পর্যায়ক্রমে সেটি ’৬৯-এর গনঅভুত্থানে এসে ঠেকে। সেখানে তিনি এক ধরনের মেসেজ পৌঁছে দিয়েছিলেন, আমরা অর্থনৈতিক স্বাধীনতা চাই। আমরা মানসিক মুক্তি চাই। আমরা আমাদের রাজনৈতিক অধিকার চাই। সেই সব অধিকার বাস্তবায়নের জন্য সামনে আসে সত্তরের নির্বাচন। সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েই জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ। অথচ ক্ষমতা লাভ করতে পারেনি। ক্ষমতা আঁকড়ে রাখে পাকিস্তান। বাঙালির শাসন তারা মানতে নারাজ বলেই ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা শুরু করে।
এরপর আসে ১৯৭১ সাল। একাত্তর সালের ৭ মার্চ তিনি ভাষণ দেন। স্বাধিকারের ভাষণ। বাঙালিমুক্তির ভাষণ। আমরা স্বাধীনতা চাই। মুক্তি চাই। এমন কথাগুলো তিনি আঙুল নেড়ে নেড়ে বলেছিলেন। আসলে সেই দিন তিনি ভাষণের ভেতর দিয়ে অভূতপূর্ব এক কবিতা রচনা করেছিলেন। যে কারণে আমরা তাকে রাজনৈতিক কবি বলে থাকি। ৭ মার্চের ভাষণটি একটি কবিতা। যে কবিতার ভেতরে নিহিত ছিল বাঙালির মুক্তির কথা। বাঙালির সম্ভাবনার কথা। বাঙালির স্বপ্নের কথা। একটি জাতিকে স্বপ্ন দেখাতে যেমন কবিতার প্রয়োজন ছিল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই কবিতাটি সেদিন রচনা করেছেন।
এরপরই আসে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ। আসলে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল তার নামের ওপর। যদিও তিনি তখন পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি ছিলেন। তবুও তার ডাকেই আপামর বাঙালি যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল দেশকে স্বাধীন করতে।
স্বাধীনতার পর তিনি যখন দেশের দায়িত্ব নেন তখন তিনি একজন শাসক ছিলেন। শাসক হওয়ার পর তার যে ভালোবাসা, তার যে ঔদার্য এককথায় তার অপরিসীম। তিনি ভালোবাসা দেখাতে গিয়ে ভুলে গেছেন পথভ্রষ্ট প্রতিপক্ষের কথা, যারা একাত্তরের যুদ্ধে দেশ ও শেখ মুজিবুরের বিপক্ষে ছিল। প্রতিপক্ষরা দিন দিন আলাদা একটা গোষ্ঠী প্রতিপালন করা শুরু করে। যার ফলে আমরা পেলাম শোকাবহ ১৫ আগস্ট।
১৫ আগস্ট আমাদের জাতীয় জীবনে এক কলঙ্কজনক অধ্যায়। এর বিচার হওয়ার পরও সে কলঙ্ক আজও মোছেনি। শারীরিকভাবে শেখ মুজিবুর রহমানকে দেশ ও জাতির কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিলেও তার কীর্তি ও অবদান কেউ মুছে ফেলতে পারেনি। পারবেও না। বাঙালি জাতির হৃদয়ে তিনি থাকবেন। যতদিন বাঙালি জাতি থাকবে, ততদিন তিনি থাকবেন।
একটা দুঃখজনক বিষয় আজ বলতেই হবে আমাকে। জাতির জনকের নাম একেকজন একেকভাবে লিখেছেন বা বলেছেন। কেউ লেখেন শেখ মুজিবুর রহমান। কেউ লেখেন শেখ মজিবুর রহমান। শেখ মুজিবর রহমান। শেখ মজিবর রহমান। তার নামের বানানে বেঠিক। সংশোধন করা আমাদের দায়িত্ব। এটা শুরু করা উচিত সাংস্কৃতিক, মিডিয়া, স্কুল, কলেজ এবং বিভিন্ন অঙ্গনের মানুষের। না, হয়তো একসময় পুরো নামটাই বিকৃত হয়ে যাবে।
শেখ মুজিবুর রহমান ক্ষমতায় আসার পর বাকশাল গঠন করেন। কেন করেছিলেন বাকশাল? করেছিলেন শোষিত মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য। সম্পদের সুষম বণ্টনের জন্য। যদিও তিনি সেসব করার সময় পাননি। তিনি যদি সময় পেতেন আমার মনে হয়, তার সুফল আমরা দেখতে পেতাম। পথভ্রষ্ট এক দল শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার মধ্য দিয়ে সে সম্ভাবনার পথ রুদ্ধ করে দেয়।
মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ বর্তমানে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। বর্তমান সরকার আওয়ামী লীগের সরকার। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে, থাকবে। এজন্য দলটিকে আরও সুসংবদ্ধ করতে হবে। শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠার জন্য জিরো টলারেন্স নিয়ে শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করতে হবে। সংগঠন ও সব অঙ্গসংগঠনের অপ্রতিরোদ্ধ নেতাকর্মীদের নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আর তা করতে হবে এখনই।
এদের বেশকিছু কর্মকাণ্ড খুব একটা সুখকর নয়। এদের অনেক খারাপ চিত্রই আমরা দেখেছি, যা দলের জন্য ক্ষতিকর। এ বিষয়গুলো সরকারপ্রধান শেখ হাসিনার মাথায় রাখতে হবে। এসব কথা বলার কারণ হল, বঙ্গবন্ধু সেই দিন যাদের হাতে নির্মম হত্যার শিকার হন তারা অপরিচিত কেউ ছিল না।
শ্রুতিলিখন : এমরান হোসেন