২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার অন্যতম আসামি দক্ষিণ আফ্রিকায় পলাতক মাওলানা তাজউদ্দিনকে দেশে ফিরিয়ে আনতে দেশটির সঙ্গে বন্দিবিনিময় চুক্তি করতে চায় বাংলাদেশ। এ ব্যাপারে দক্ষিণ আফ্রিকার দেয়া চুক্তির খসড়া বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সংযোজন-বিয়োজন শেষে চূড়ান্ত করে দেশটিকে হস্তান্তর করা হয়েছে।
এখন দক্ষিণ আফ্রিকা সম্মত হলেই চুক্তি সই হবে। এ ছাড়া মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট চুক্তি নামের আরেকটি চুক্তি নিয়ে আলোচনা চলছে।
দক্ষিণ আফ্রিকায় নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার সাব্বির আহমেদ চৌধুরী বৃহস্পতিবার টেলিফোনে যুগান্তরকে বলেন, ‘আমাদের অনুরোধে দক্ষিণ আফ্রিকা কর্তৃপক্ষ বন্দিবিনিময় চুক্তির একটি খসড়া দিয়েছিল। এ খসড়া বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ঢাকায় পর্যালোচনা করে সংযোজন-বিয়োজনের পর তা চূড়ান্ত করার জন্য সম্প্রতি আবার দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এখন দক্ষিণ আফ্রিকা এটি চূড়ান্ত করলে দু’দেশের মধ্যে বন্দিবিনিময় চুক্তি সই হতে পারে।’
তাজউদ্দিনকে ফিরিয়ে আনার জন্য এ চুক্তির প্রয়োজন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘দক্ষিণ আফ্রিকায় মৃত্যুদণ্ডের কোনো বিধান নেই। এখন দেশটির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে যে, তাজউদ্দিনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে না- এমন অঙ্গীকার করলে তারা তাকে ফেরত দিতে পারে। কিন্তু গ্রেনেড হামলা মামলার বিচার এখনও সম্পন্ন হয়নি। ফলে রায়ে কী হবে সে সম্পর্কে আগেভাগেই কিছু বলা যায় না। এ কারণে বাংলাদেশের পক্ষে মৃত্যুদণ্ড হবে না, এমন কোনো অঙ্গীকার করা সম্ভব নয়।’
সাব্বির আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘এ পরিস্থিতিতে আমরা বন্দিবিনিময় চুক্তি করার উদ্যোগ নিয়েছি। এ উদ্যোগের আওতায় মাওলানা তাজউদ্দিনকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছি। তবে দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে আলোচনা এখনও শেষ হয়নি।’ তিনি আরও বলেন, ‘মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট চুক্তির খসড়াও দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এখন এ দুটি চুক্তির ব্যাপারে দক্ষিণ আফ্রিকার মতামত পাওয়ার অপেক্ষায় আছি।’
এক প্রশ্নের জবাবে প্রিটোরিয়া থেকে টেলিফোনে বাংলাদেশের হাইকমিশনার আরও বলেন, ‘দক্ষিণ আফ্রিকার বিচার বিভাগ গোপনীয়তা বজায় রাখে। তাই মাওলানা তাজউদ্দিনের অবস্থানের ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু জানায় না। তবে দেশটির সরকারের তরফে আমাদের কাছে এটা নিশ্চিত করা হয়েছে যে, তাজউদ্দিন পাকিস্তানি পাসপোর্ট নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় যান। এখনও তিনি দক্ষিণ আফ্রিকাতেই আছেন। দক্ষিণ আফ্রিকার সরকারের নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই আছেন তিনি।
সাব্বির আহমেদ চৌধুরী বলেন, দক্ষিণ আফ্রিকায় অনায়াসেই রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়া যায়। জিম্বাবুয়ে, সোমালিয়া, মোজাম্বিকের অসংখ্য মানুষ কোনো ডকুমেন্ট ছাড়াই দেশটিতে রাজনৈতিক আশ্রয় পেয়েছেন। ফলে তাজউদ্দিন রাজনৈতিক আশ্রয় পেয়ে থাকতে পারেন বলে অনুমান করা যায়।
সূত্রমতে, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার পলাতক আসামিদের অবস্থান জানতে বাংলাদেশ সরকার অনেক আগেই ইন্টারপোলের সহায়তা চায়। ইন্টারপোলের পক্ষ থেকে পুলিশকে জানানো হয়, আসামিদের মধ্যে মাওলানা তাজউদ্দিন দক্ষিণ আফ্রিকায় আশ্রয় নিয়েছেন। তারপর থেকেই তাকে ফিরিয়ে আনার জন্য কূটনৈতিক যোগাযোগ শুরু হয়।
প্রসঙ্গত, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের সমাবেশ চলাকালে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান ওই সময়ের বিরোধীদলীয় নেত্রী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। হামলায় আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত হন। আহত হন দলের তিন শতাধিক কর্মী। ঘটনার পরদিন মতিঝিল থানার উপপরিদর্শক (এসআই) ফারুক আহমেদ একটি মামলা করেন। মামলাটি প্রথমে তদন্ত করে থানা পুলিশ। পরে তদন্তের দায়িত্ব পায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। এরপর মামলাটি যায় অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি)। ওই সময়ে সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার মুন্সী আতিকুর রহমানের নেতৃত্বে প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করে জজ মিয়া নামের একজনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেয়া হয় যা ‘জজ মিয়া নাটক’ নামে পরিচিত। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় যাওয়ার পর তদন্তের দায়িত্ব পান সিআইডির আবদুল কাহার আকন্দ।
২০০৯ সালের ৩ আগস্ট রাষ্ট্রপক্ষ মামলাটি অধিকতর তদন্তের আবেদন করলে ট্রাইব্যুনাল তা মঞ্জুর করেন। ২০১১ সালের ৩ জুলাই তারেক রহমানসহ ৩০ জনের নাম যুক্ত করে মোট ৫২ জনকে অভিযুক্ত করে অভিযোগপত্র দেয়া হয়। তবে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলার দায়ে জঙ্গি নেতা মুফতি হান্নান ও শরীফ শাহেদুল আলম বিপুলের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ায় মামলা থেকে তাদের নাম বাদ দেয়া হয়। এখন একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার আসামি সংখ্যা ৪৯ জন। এদের মধ্যে তারেক রহমানসহ ১৮ জন পলাতক রয়েছেন। এ ছাড়া জামিনে আট ও কারাগারে রয়েছেন ২৩ জন।
